Shwapnoghori - Ahmed Firoze

স্বপ্নঘড়ি : আহমেদ ফিরোজ

স্বপ্নঘড়ি
আহমেদ ফিরোজ

ছেলেটি মেয়েটিকে বলল, তুমি কি স্বপ্নঘড়ি পরবে?

মেয়েটি ঠোঁটের কোণে একবিন্দু হাসি ঢেলে বলল, ও স্বপ্নঘড়ি! দেবে তুমি?

ছেলেটি সম্মতিসূচক মাথা দোলাল।

মেয়েটি পুনশ্চ হাসি ছুঁড়ে দিল ছেলেটির অস্ফুট চোখের কাচে।

ছেলেটি বড় বড় চোখ করে তাকাল—নদীর জোয়ার জলের মতন শীতলোষ্ণতায়।

মেয়েটি সলাজে চোখ নিচু করল।

ছেলেটি হাত বাড়াল, মেয়েটি ছেলেটির হাত থেকে স্বপ্নঘড়ি পরে নিল।

ছেলেটি মেয়েটির গলায় চাঁদঘড়ি পরিয়ে দিল, ঠোঁটে কাঁপনঘণ্টা, চোখে আলোঘণ্টা, মাথায় সূর্যটিকলি।

মেয়েটি নরম করে হাসল।

ছেলেটি ঠোঁট মেলাল।

মেয়েটি বুকপকেটে লুকিয়ে রাখা জোনাকপোকার বন্ধদুয়ার খুলে দিল।

ছেলেটি সবিস্ময়ে চেয়ে রইল আকাশভাঙার দিন চেয়ে।

মেয়েটি সমুদ্রস্নানের পূর্বাভাসে উঠে দাঁড়াল।

ছেলেটি হাঁটুভাঙা নদীর মতন পড়ে রইল ডাঙায়।

মেয়েটি সমুদ্রগামী।

ছেলেটি খোঁয়াড়ে আটকেপড়া একটা—একচক্ষু হরিণ।

মেয়েটি নদীর কূল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল প্রাচীন সব নগরীর কাছে, যেখানে পূর্বপুরুষদের মৃত আত্মারা সভা বসিয়েছে রাষ্ট্র ভাঙার। নতুন প্রজন্মের যারা এসেছিল, তারা সংখ্যায় এতই কম ও শঙ্কিত যে, কথা বলার সঠিক সময়টিই খুঁজে নিতে পারছিল না। এদিকে মেয়েটি সেই সভায় সবাইকে একরকম হুমকি-তাড়িয়ে ফেরার গান গেয়ে বলল, দেখ, আমিই একমাত্র—যে তোমাদের মাঝে জীবিত। অতএব নেতাও হবো আমি এবং এখন থেকে আমার আদেশ-আজ্ঞা পালিত হবে বছরে বছরে। এবার সে চিৎকার করে উঠল, তোমরা কেউ কি এর বিরোধিতা করতে চাও? সঙ্গে সঙ্গে মৃতপল্লীজুড়ে অসংখ্য অদৃশ্য আরো অনেক আত্মা দেখা গেল।

কেউ সাহস করল না। সবাই নতমুখে শুয়ে পড়ল। নবোত্থিত নেতার চোখ থমকে গেল এবং একসময় নিজেই নিজের দিকে নিম্নগামী হলো। কারণ ঐসব আত্মাদের বিশেষ কোনো আব্রু ছিল না—যা দ্বারা তারা তাদের নতুন নেতাকে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাতে পারত। নেতার মুখ লাল দগদগে একটা আগুন খণ্ডে পরিণত হলো। মুহূর্তে আগুনের উত্তাপ এত বেড়ে গেল যে, সব মুখগুলো ঝলছে বীভৎস ও কয়লা বর্ণশ্রী খুঁজে পেল। একটিও আর তার পছন্দের রইল না। নেতা আসন ছেড়ে যখন বেরিয়ে এলো, তখন খনিশ্রমিকের মতোই দেখাচ্ছিল তাকে।

পুরনো সেই দেশকাল : একটি নদী পড়ে আছে অভুক্ত, শুষ্ক, কাঠফাটা মাটির চাপ চাপ রক্ত বুকে ধরে। মেয়েটি সমুদ্রের উত্তাল স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল—শহর-নগর, গ্রাম-গঞ্জ, নদী-অনদী, পুকুরঘাট-বাজার-মসজিদ, অন্যান্য ধর্মালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শহরের মোড়ে মোড়ে বেড়ে ওঠা একটা ছোট্ট বার। যেখানে নারী-পুরুষের অবাধ প্রবেশ ছিল। আর নারীরা পুরুষের কাছে, পুরুষেরা নারীদের কাছে ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তারা পানের সঙ্গে খাদ্য হিসেবে তরুণ-যুবা থেকে শুরু করে প্রবীণের কুচকানো চামড়া ও শিশুর অস্ফুট কান্না একত্রে খেয়ে ফেলত। দিনে দিনে শহরটা এমনই হয়ে উঠেছিল যে, মানুষগুলো যেন আর মানুষ থাকছে না।

কেউ কেউ নিজেকেই ঈশ্বর বলে দাবি করে বসেছে, আবার কেউ কেউ দাবিনামা পেশ করছে ঈশ্বর বরাবর। সাধারণ মানুষ, গরু-ভেড়া একত্রে এককাতারেই ধর্মালয় ও শিক্ষালয় বাড়িয়ে চলেছে। প্রহসনের বিচারে গণধর্ষণ চলতে থাকল সর্বত্র, খুন যেন ক্ষমতাশীলদের পেশা হয়ে দেখা দিল। আর দলীয়করণ ও স্বজনভোজন রাত-দুপুরে, সকালে-বিকালে এমনভাবে চলল যে খোদ দলের লোকজনই বিগড়ে গেল।

মেয়েটি এদের এইসব দেখেশুনে পুনশ্চ সিদ্ধান্ত নিল ফিরে যাবে—মৃতপল্লীতে, কিন্তু সেখানেও কাঠ-কয়লার বিবর্ণ ছবি মনে পড়ায় কিছুটা পিছিয়ে পড়ল ভাবনা থেকে। এরই মধ্যে ছেলেটি হাঁটুভাঙা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং এক-পা দু-পা করে হাঁটতেও শিখেছে।

মেয়েটি ছেলেটির আসার জন্য অপেক্ষা করতে চাইল। কিন্তু তার দোমনা মন শুরুতেই বারবার বাঁধ সাধছিল এই বলে যে, সেকি তাকে আগের মতোই পছন্দ করবে, ভালোবাসবে, পরিয়ে দেবে স্বপ্নঘড়ি? মেয়েটি আর কিছুই ভাবতে পারছিল না। এর মধ্যে ছেলেটির ছবি-মুখশ্রী সবুজ আঙিনাজুড়ে ভেসে উঠল।

মেয়েটি কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না, কারণ মধ্যবিত্ত মন কতদিকেই না ছুটে বেড়ায়—ঘর-সংসার, বাবা-মা, পুরুষ-অপুরুষ, ধর্ম-অধর্ম, আবার প্রেমিকদের ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত উৎপাত। মেয়েটির অহঙ্কারী চোখ বুজে এলো।

ছেলেটির হাত বাড়াল, কিন্তু সে যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। মেয়েটি চোখ খুলে কিছু সবুজ দেখতে পেল এবং আরো দূরে চাপ চাপ রক্তের নিশানা।

মেয়েটি এবার নিজেই হাত বাড়াল।

ছেলেটি প্রসারিত করল, কিন্তু স্বপ্নঘড়ি খুঁজে পাওয়া গেল না। দুটি নিরন্ন হাত একে-অপরকে ছুঁয়ে দিল। এরপর ধীরে ধীরে ধোয়াশা সবরঙ কেটে গেল।

মেয়েটি এবার চিৎকার করে বলল, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?

ছেলেটি কোনো উত্তর করল না।

মেয়েটি আবারো চিৎকার করে বলল, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?

ছেলেটি এবারো কোনো উত্তর করল না।

মেয়েটি এবার সমস্বরের উচ্চারণে কণ্ঠ ফাটিয়ে বলল, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?

সদুক্তি এলো—স্বপ্নঘড়ি হারিয়ে গেলে ভালোবাসা শুধু নয়, প্রেমও চলে যায়। আর প্রেম চলে গেলে কোনো ভালোবাসাই থাকে না।

মেয়েটি নিস্তরঙ্গ মেঘের মতন আকাশের গায়ে ভেসে রইল। ছেলেটি অদৃশ্য বাতাসের শব্দতরঙ্গে মিশে গেল।
এরপর কালক্ষেপণের কালে বাতাসের গতি বাড়ল, মেঘের গায়ে মেঘ দুরত্বের সংঘাতে বারবার ধাক্কা গেল; অবিরাম বৃষ্টির ধারায় ঝরে পড়ল জগতের বিচ্ছুরিত আলোর কণার সঙ্গে খণ্ড খণ্ড প্রেম। মানুষেরা প্রেম ও ভালোবাসার অসমযুদ্ধে ডুবে রইল কূলপ্লাবি হাজারো স্মৃতি ভেঙে।

মেয়েটি আর কখনো ফিরে এলো না, ছেলেটিও। মেঘ ও বাতাসের কোরাসে জল-বৃষ্টি রয়ে গেল, প্রেম; মানুষের হাতে নকল স্বপ্নঘড়ি।

-০-

আরো গল্প পড়তে নামের উপর ক্লিক করুন :
রূপ
ক্যামেরা ও চোখ
ঘর
আই লাইক ইট
স্বপ্নঘড়ি
Share us

Leave a Reply

Your email address will not be published.