I like it - Ahmed Firoze

আই লাইক ইট : আহমেদ ফিরোজ

আই লাইক ইট
আহমেদ ফিরোজ

আপনি আরিফ ভাইয়ার বন্ধু!
ও বুঝতে পেরেছি, আপনি সোহেল ভাইয়া।
কতদূর থেকে এসেছেন?
আমারও না খুব ইচ্ছে করে দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে, পারি না, পারি না কেন জানেন, আমি যে মেয়ে, আমার তো একা বাইরে যেতে নেই, আর দূরে? তা তো একেবারেই নয়, চারদুয়ারী ঘর আর চৌকাঠ আমার ঠিকানা।
আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।
এই দ্যাখেন আপনাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কী-সব বকছি। আপনি বিরক্ত হন নি তো?
ট্রেনে এসেছেন বুঝি, আপনার তো ট্রেন জার্নি খুবই প্রিয়। তা আসতে কষ্ট হয় নি তো?
জানেন, আমরাও না একবার গ্রামে গিয়েছিলাম—ট্রেনে চড়ে। কী-যে ভাল্লাগে, কিন্তু কী জানেন, আমাদের সেবার বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল। আন্তঃনগর ট্রেনও এখন লেট করে আসে, আর হকার—ওরাও যেন ‘হাঁও-মাঁও মানুষের গন্ধ পাঁও’—লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ে।
সেবার, ট্রেনের মাথা বিগড়ে গেলে, মাঝপথে নেমে নৌকায় করে যাওয়া।
আপনি নৌকায় চড়েছেন কখনো?
নৌকায় না মাঝি নেই, ভটভট করে স্যালো স্টার্ট দিয়ে—একজন রোগা লোক, একটা লোহার ডাণ্ডি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, নিচে ছিল লোহার পাতের একটা চ্যাপ্টা খাপড়া লাগানো।
আমরা যখন যাচ্ছিলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে, সূর্য হেলে পড়েছিল আর দু’ধারে এমনকি আশেপাশে কোথাও কোনও কাশবন ছিল না, শুধু মিহি বাতাসে খাগড়া গাছের মাথাগুলো এলোমেলো দুলছিল—বিরতি দেয়ার ভঙ্গিতে কোনও এক অদৃশ্য ইশারা পেয়ে। শরৎকালের আকাশে ছিল ভাঙা-ভাঙা মেঘ, শাদা কেশর দুলিয়ে যেন মেঘবালিকারা খেলা করছিল অনন্তকালের যাত্রায় পড়ে।
আপনি মেঘ দেখেছেন কখনো?
আমি না ছোটবেলায় একবার পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম, এই যে কেণি আঙুল, একটু বাঁকা লাগছে না? লাগছে, পড়ে গিয়ে এটা বাঁকা হয়ে গেছে, কত এন্টিবায়োটিক খেলাম—একদম সোজা হলো না। পেয়ারা আমার খুবই প্রিয়।
আপনি পেয়ারা খেয়েছেন কখনো?
এই দ্যাখেন, আপনার সঙ্গে শুধু বকবকই করছি। নাস্তা-টাস্তা কিছু করে নেন।…
বাসায়-না কেউ নেই, আম্মু কলেজে আর আব্বু তো সাত-সকালে অফিসে যান, ফেরেন—রাত দশটা-এগারোটায়, আর ভাইয়া, সে-তো সকালেই বের হন, বলেন—চাকরি নেই, বাকরি নেই—বেকারদের আবার সময়জ্ঞান থাকতে হয় নাকি?
আপনি কিন্তু আঙুরগুলো একদম খাচ্ছেন না?
কাজের বোয়া, সে-ও নেই। এক সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলে কী— ‘আমি গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি, আর হয়তো আসব না।’ আমি না কিছুই জিজ্ঞেস করি নি। যেতে-যেতে আরও কি-কি বলল জানেন, ‘তুমি দারুণ মিষ্টি মেয়ে, আর তোমার ভাইয়া খুব ভালো।’
গত দুই মাসে বুয়া আর ফিরে আসেনি।
বুয়া যাবার পর মা একবারও ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলেননি। ভাইয়াও না। প্রথম ক’দিন ভাইয়া যেচে কথা বলতে চাইলে, মা এড়িয়ে যেতেন। এখন-না একটু একটু কথা হয়। গত সপ্তাহে ভাইয়ার রেজাল্ট হলো, ভাইয়া ফার্স্ট ক্লাস ফোর্থ হয়েছে, আম্মু তাতেই ভীষণ খুশি, ছয় কেজি মিষ্টি এনে মহল্লা-শুদ্ধ লোকদের খাইয়েছে, শুধু এক কেজি রসগোল্লা এনেছিল বাসার জন্যে।
আপনি রসগোল্লা খেয়েছেন কখনো?
বাবাও আর আগের মতো কথা বলেন না। কেমন যেন একরোখা হয়ে গেছেন। একদিন না, কী হয়েছিল জানেন—কলেজ থেকে ফিরে দেখি, ছোট খালার বয়সী একজন মেয়েমানুষ সোফায় বসে আছেন, আম্মু গোমরা মুখে বড় চেয়ারটায় আর আব্বু ও-পাশটায় বসে-বসে সিগারেট ফুঁকছিলেন। আমাকে দেখে কেউ কোনও কথা বলছিল না, হয়তো পূর্বেই বলা হয়েছে অনেক, তাই আর কেউই কিছু বলছিল না, দেখতে দারুণ স্মার্ট ছিলেন মেয়েটি, তিনিও কিছু না-বলেই উঠে চলে গেলেন। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, আম্মুর ছাত্রী-টাত্রী বা কলিগ কেউ হবেন।
আম্মুকে বললাম, ‘কে উনি’, কিছু না-বলেই চেয়ার থেকে শব্দ করে উঠে উঁচু গলায় বললেন, ‘তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর।’
আম্মু কিন্তু আমার সঙ্গে কখনই তুই করে কথা বলতেন না আর উঁচুস্বরে তো নয়ই, আম্মু কেমন যেন একটা দাঁতভাঙা জবাব দিলেন, মনে হলো, শব্দচারটি একটার সঙ্গে আরেকটা বাড়ি খেয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল, তার পর আরও একবার মনে হলো, শব্দগুলো যেন একটা আরেকটাকে হাতুড়ি দিয়ে পেটাল খটখট করে।
আব্বুর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘উনি কে আব্বু?’
আব্বু গড়গড় করে, ‘তোকে এতকিছু জানতে হবে না’—বলেই উঠে পড়লেন।
আমার না খুব কান্না পেল, আব্বুও তুই করে বলছেন। কিছুক্ষণ পর আব্বু দ্রুত পায়ে হেঁটে বাইরে চলে গেলেন।
এরপর কী হয়েছে জানেন, আব্বু-আম্মুর ঘরে এখন আম্মু শুধু একা ঘুমান, আব্বু গেস্টরুমে। মাঝখানে ক’দিন আম্মুর ঘরে আব্বু ঘুমালেন, আম্মু গেস্টরুমে। মাঝে মাঝে দু’জনেই ঘুমান না—কেউ গেস্টরুমে, কেউ বাথরুমে, কেউ লাইব্রেরি রুমে, কেউ টিভি রুমে, কেউ বারান্দায়, কেউ ছাদে।
একদিন কী হলো জানেন, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ আম্মুকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করল, আম্মুর রুমে আম্মু নেই, গেস্টরুমে গিয়ে দেখলাম আব্বু নেই, এমনকি কোনও রুমেই। ভাইয়া তার রুমে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। অনেক খুঁজে দেখি—আব্বু, আম্মুর বারান্দায় দাঁড়িয়ে, আম্মু নেই, কাউকে কিছু না বলেই দৌঁড়ে ছাদে গিয়ে দেখি—আম্মু।
আমি তো ভীষণ ভয় পেয়ে গেছি, আম্মু সন্ধ্যার পরেই একা একা ছাদে যেতে ভয় পান—অথচ আজ রাতদুপুরে একা আম্মু—একটুও ভয় করছে না, কাছে গিয়ে ভয়ে-ভয়ে বললাম, ‘আম্মু’।
আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে কী যে কান্না। কান্না থামতেই চাচ্ছিল না, এত করে বলি, ‘আম্মু কেঁদো না, তোমার কান্না দেখে আমারও কান্না পাচ্ছে, কী হয়েছে বলো।’ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু কেঁদেই চলেছেন, আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, আব্বুকে জানালে—আব্বুও যেন ভয় পেয়ে গিয়ে ছুটে আসলেন, আব্বু আমি দু’জন মিলে কত অনুরোধ-বিনিরোধ করে কান্না থামিয়ে রুমে এনে শুইয়ে দিলাম, আব্বুকে মাথার কাছে বসিয়ে রেখে।
এখন আব্বুও কেমন বদলে গেছেন, আম্মু নিজের মতো সবকিছু গুছিয়ে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর ভাইয়া, আগে তো কথাই বলা যেত না, শুধু ধমকের সুরে কথা বলতেন, চোখ বড় বড় করে। বুয়া যাবার পর থেকে ভাইয়াও নীরব, নিশ্চুপ, এখন আর ধমক দেন না, কেমন ম্রিয়মাণ—দেয়ালে সেঁটে যাওয়া পুরানো ফ্রেমবন্দি গ্যঁগের কোনও হারিয়ে যাওয়া প্রোট্রেট।
ভাইয়ার চোখ এখন সবসময় লাল হয়ে থাকে। কিন্তু জানেন, ভাইয়া সিগারেট পর্যন্ত টানেন না। আর অন্যকিছু, না না। মহল্লার সবাই বলে, ‘আমার ভাইয়ার চরিত্র, শুচিশুদ্ধ পবিত্র।’
জানেন, এখন আর-না কেউই আমার সঙ্গে তেমন কথা বলে না, সবাই সবার দিকে হারানো দিনের করুণ শিকারীর চোখে চোখ রেখে চলে; আমি শুধু একা, একাকী—একা।
আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন?
ও-কী! ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে কী লিখেছেন, দেখি দেখি?
আপনি বুঝি কথা বলতে পারেন না!
…তাতে কী হয়েছে?
মোটা দাগে কী লিখেছেন?
‘I like it.’
হায়, আল্লা! আপনি আমার কথা—সব বুঝেছেন!

Share us

Leave a Reply

Your email address will not be published.