Rup - Ahmed Firoze

রূপ : আহমেদ ফিরোজ

রূপ
আহমেদ ফিরোজ

গ্রামো মেঠোপথ, দূর থেকে একদল লোককে চোখে পড়ল। নারী-পুরুষ—বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর থেকে সববয়সের মানুষের যাত্রারধ্বনি। তারা একসময় সোজা না-গিয়ে পশ্চিমদিকের বিস্তৃত ধানক্ষেতের মোটা আল ধরে হাঁটতে থাকে। বিকেলের লাল আলো সন্ধ্যার কুয়াশাবর্ণে ক্রমশ হাবুডুবু খেতে থাকে। মাঠ পেরিয়েই জঙ্গলাকীর্ণ একটি পোড়োবাড়ি। বাড়িঘর বলতে এখন আর কিছুই নেই—ইট-কাঠের ভস্মাংশ ছাড়া। মাঝখানে ফাঁকা জায়গা, পাশেই একটা খুপরি মতো ঘর। এ-ঘরেই চৌত্রিশ বছর ধরে উত্তরাধিকারসূত্রে দূরাত্মীয় একজন বৃদ্ধা বাস করত, তার গায়ের রং তামাটে আর চোখদুটি ছিল ভয়ঙ্কর উজ্জ্বল। সে-ও এখন আর আর নেই, গত বছরের বন্যায় ভেলা করে মাছ ধরতে গিয়ে ফেরে হয়নি। অযত্ন পতিতকরণে ছাপরা ঘরের এফোঁড়-ওফোঁড় দেখা যায়। আশপাশের গ্রাম থেকে এই ভিটাটি প্রায় নয়-দশ ফুট উঁচু। প্রশস্ত কয়েক একর। বন্যার সময় নিচভূমির গরিব ও খড়কুটো মানুষের সৌভাগ্যভূমিতে পরিণত হয়। অন্যসময় দশগ্রামের বিচারালয়। খোলা আকাশের নিচে মানুষগুলো বসে ঠিকই, কিন্তু মাতব্বরদের খোলা মন পাওয়া ভারি দায়।
বিচার মজলিস। বিচারক সাত-আটজন বুড়ো-জোয়ান : কারো বয়স ত্রিশ-চল্লিশ, কারো পঞ্চাশ, দুজন ষাট-সত্তর, বাকি একজনের পঁচাত্তরের উপরে। সবাই চেয়ারে বসা। কিছু লোক ইতোমধ্যে চারদিকে বসে পড়েছে, সামনের দিকে গোল করে আরো বেশ কজন দাঁড়িয়ে, বামপাশে কয়েকজন শিশু-কিশোর ও মহিলা। একটু দূরে গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রেমের কারণে দোষী আলোকের বড়বোন ও মা। মজলিসের মাঝখানে আলোক, তার পেছনে বৃদ্ধ বাবা, ছোটভাই, সাথে দুটো বাচ্চা ও ভাবী।
—এলাকার প্রভাবশালী (মজলিসের প্রধান) চেয়ারম্যানের মেয়েকে ভালোবাসার দায়ে ছোটভাইয়ের প্রেমের বলি হিসাবে মজলিসের সর্বসম্মত বিচারে বড়বোন আফরিনকে নির্যাতনের নির্দেশ দেয়া হতে পারে। সময় সন্ধ্যার পর পর, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, একটা হেজাগ বাতি আঁধার তাড়াচ্ছে আঁধারে, সঙ্গে দু’তিনটা কেরাসিন বাতিও আছে।
কোনো সাক্ষী-সাবৎ বা আলাপ-আলোচনা না-করেই, পূর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্তানুযায়ী রায় ঘোষণার মতো করে বিচারকদের একজন চেয়ারম্যানের চোখে চোখ মানিয়ে কিছুটা ঝুকে গিয়ে পুনরায় মাথা উঁচু করে কাঁধ দুটো ফুলিয়ে অন্ধের মতো মুখস্থ পাঠ করে—
—এলাকার গণ্যমান্য আমাদের তিনপুরুষের শ্রদ্ধাভাজন নেতা চেয়ারম্যান সাবের একমাত্র মেয়ে মা মরিয়মের দিকে শুয়োরের বাচ্চা হাত বাড়িয়েছে। ফকিন্নীর পুত ফকিন্নী। (খিস্তিমাখা কণ্ঠে হাত দিয়ে ইশারা করে আলোককে দেখিয়ে লোকটা যেন থামে। আলোকের বৃদ্ধ বাবার মুখটা ছোট হয়ে আসে।) ঐ যে দূরে মা-বোন দাঁড়িয়ে। ওদেরই সাহস-উৎসাহে এতদূর এগিয়েছে, এর বিচার হবে ভয়াবহ। রায় কার্যকরের অনুমতি করবেন মসজিদের ইমাম সাহেব।
হাত দিয়ে দেখাতেই বিচারক আটজনের পাশের চেয়ারে মলিন মুখে বসা ইমাম সাহেব ছাগলা দাড়ি খোঁচাতে খোঁচাতে নিজের উপস্থিতি প্রমাণ করেন। রায় ঘোষণা শেষ হয় না, লোকটি অহংকারের সঙ্গে রায়ের বাকি অংশ বলতে কণ্ঠ শান দেয়ার ভঙ্গিতে খাঁকার দিয়ে শুরু করে—
বিচার আর কিছু না মিয়ারা, আমাদের মধ্যে সামর্থ চারজন মা মরিয়মকে ভালোবাসার দায়ে ঐ কুত্তার বাচ্চার বড়বোনকে প্রকাশ্যে ইজ্জতহানি করবে। কি বলেন ইমাম সাহেব?
লোকটি একফাঁকে অন্য বিচারকদের কাছ থেকেও সম্মতিসূচক ইশারা আদায় করে নেয়। এরপর মাথা ঝুকিয়ে প্রথমে ইমাম সাহেবকে, আরো নতমুখে চেয়ারম্যানকে সম্বোধন করে। চেয়ারম্যান মুখ বড় করে উৎফুল্লের হাসি ঝরিয়ে ঘাড় ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালেন। ইমাম সাহেব কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু চেয়ারম্যানের চোখে চোখ পড়তেই তা দপ করে নিভে যায়। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের চারজন বিচারক উঠে দাঁড়ায়, সত্তর বয়সী একজন দাঁড়াতেই চেয়ারম্যান ধমকের স্বরে তাকায়। লোকটি সারাজীবনেও সমুদ্রমুখ না-দেখার বেদনায় শব্দ করে বসে পড়ে। চারজনের মুখে জগতের সকল আনন্দের হাসিশুভ্রতা লুকিয়ে। একজনের পা খোঁড়া। চারজন মিলে দৌড়ানোর ভঙ্গিতে গিয়ে মেয়েটিকে মায়ের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে এসে সবার সামনে বেআব্রু করতে চাইলে চেয়ারম্যান ভয়ঙ্কর মূর্তিতে চেঁচিয়ে ওঠে। দলে যোগ দেয় চেয়ারম্যানের মাস্তান কিসিমের পোশাকি হ্যাবলা ছেলেটাও। চেয়ারম্যানের চোখে চোখ পড়তে সে অস্ফুট স্বরে ‘আব্বু’ বলে নেতিয়ে পড়ে যেন। পাঁচজন মিলে মেয়েটিকে পাশের একটা খুপরি ঘরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন শুরু করে। আঁধার ফুঁড়ে গোঙানি আর চিৎকার বিদীর্ণ করে—রাতের কোলে নেমে আসা নক্ষত্রমণ্ডলকে।
এরপর নতমুখী লোকগুলো ঘরমুখো হয়, চেয়ারম্যানের পেছনে পেছনে বাকি বিচারক, ইমাম সাব অনেক আগেই স্থান ত্যাগ করেছে। মা গাছের সঙ্গে মাথা ঠুকছে মৃত্যু-কান্নায়। চেয়ারম্যানের আদেশ-আজ্ঞা পালনকারী চৌকিদার-দফাদার ও অন্যেরা মিলে আলোক, তার বাবা, ভাই-ভাবী-বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে চলল আলো-আঁধারের ঘেরাটোপ দূরে ফেলে।
ভোর-আলোর সময়-পাশে টপ টপ বৃষ্টির ফোঁটা মুখের উপর পড়লে জ্ঞান ফিরে পায় আফরিন, লুটিয়ে পড়া থেকে ওঠে বসে। ধর্ষিতার চরম মুখশ্রী। আযানের ধ্বনি শোনা যায়, এতক্ষণে ভোরের পূর্বাভাসও খুপরি ঘরের বাইরে এসে হাত-পা নাড়ছে। মা গাছের গোড়ায় রক্তাক্ত পড়ে আছে, মৃত। সে বোবা ভঙ্গিতে উঠে আবছা আলোয় বিলিকাটা ভোরে বিধ্বস্ত জামাকাপড়ে টলমল অবস্থায় হাঁটতে থাকে, পাশের বড় খালের পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় সে দূরে একটি সাঁকোর মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। দূর থেকে আবছা আলোয় একধরনের ধোয়াসা ছড়িয়ে আছে। সে একপা-দু’পা করে সাঁকো ধরে হাঁটতে থাকে, মাঝামাঝি এলে একসময় দূর হতে শুধুই দূরত্ব বাড়ায়।
এই ঘটনাটির পুরোটাই টিভির পর্দায় দেখে একজন দর্শক। পর্দায় ভেসে ওঠে রচনা ও পরিচালনা আহমেদ কবির। এরপর বেসিনে গিয়ে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে শুয়ে পড়ে মানুষটি। যিনি প্রদর্শিত নাটকটির চিত্রনাট্যকার, পরিচালক এবং নায়কও।
যে সময়ে মেয়েটি সাঁকো পার হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই ভোর পাঁচটার দিকে কলিংবেলের শব্দে কবিরের ঘুম ভেঙে যায়। ব্যাচেলর লাইফে অভ্যস্ত একটি দু’কামরার ফ্লাট বাসায় তার অবস্থান। ঘুমচোখে সে দরজা খোলে। একজন আগন্তুক মেয়ে দাঁড়িয়ে, যাকে এর আগে কখনো সে দেখেনি। অনেকটা না-দেখেই কথা বলতে শুরু করে।
—কাউকে চাচ্ছিলেন?
—হ্যাঁ।
—কাকে?
—আপনাকে।
মুখে একটুখানি চাপা হাসি এনে—
—আমাকে, কেন?
—তার আগে বলুন, হাসলেন কেন?
একইরূপ হাসি দিয়ে—
—হাসলাম কেন? তা তো জানি না।
—না, আপনাকে বলতেই হবে হাসলেন কেন?
এবার বিরক্তিভাব মুখ করে চোখের ঘুম ছাড়াতে ছাড়াতে—
—দেখেন চোখে অনেক ঘুম, কিছু বলতে চাইলে বলুন, না তো…
—না তো মানে?
আধো চোখ খুলে দরজা দেখিয়ে—
—বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
ঠোঁটে নির্লিপ্ত হাসি ঝরিয়ে—
—আপনি আহমেদ কবির তো?
নাম ঠিক বানানে সঠিক উচ্চারণ করায় কবিরের কণ্ঠে কিছুটা নমনীয়তা নেমে আসে।
—তা ঠিক আছে।
—ভেতরে একটু বসতে পারি।
—বসতে পারি মানে?
আবছা চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, একটু ভেবে—
—বাসা কোথায়?
মেয়েটি হাত দিয়ে ইশারা করে অপজিট ফ্লাটটি দেখায়। করিডোরের ওপাশে শীতালো ছড়িয়ে ভেজানো দরজা।
হাতের আঙ্গুল ছুড়ে—
—ওই বাসা?
—হ্যাঁ।
—আসুন।
ছোফায় মুখামুখি বসে দু’জনে।
—আচ্ছা মেয়েটি কি পরে আত্মহত্যা করল।
—না।
—তা-হলে?
—তা তো জানি না।
—বাহবা, আপনি লেখক, জানবেন না!
—আত্মহত্যা করল না—এটা শুধু জানি।
—বা-বা বেশ বলেছেন।
—না—আসলে, আমি দেখাতে চেয়েছি ঐ ঘটনাটির পর মেয়েটি অন্তত আত্মহত্যা করল না, তারপর অনির্দিষ্টতার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কারণ সে ওখান থেকে প্রতিশোধাগ্নি হতে পারে, কিংবা পরিচিত সমাজ থেকে দূরে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে। আবার ধ্বংস হয়েও যেতে পারে।
—ধ্বংস হয়েও যেতে পারে মানে?
—এ-ই পতিতা-টতিতা আর কি?
ভয়ঙ্কর অট্টহাসি ঝরিয়ে—
—বাহবা! ওমন চমৎকার সমাজের একটি ক্ষতকে তুলে ধরলেন। আবার নায়িকাকে ছেড়ে দিলেন অনির্দিষ্ট একটি স্বপ্নাবিষ্ট গন্তব্যের হাতে। বা কবির সাহেব, বা।
দেয়ালের যেদিকটায় পোড়োকালের কোনো-এক আর্টিস্টের আঁকা একটি পোট্রেট টাঙানো, সে-দিকটায় উঠে গিয়ে দাঁড়ায় আফরিন। নারী-পুরুষের সনির্বন্ধ একটি খোলা পোট্রেট, পাশে ছাপ কাটা শিশুর মুখ। ঠোঁট দুটো নড়েচড়ে উঠেও থেমে যায়, কারণ সে অন্যমনস্ক হয়ে পোট্রেটটির দিকে চেয়ে আছে।
ঘুমঘোর চোখে কবির কিছুটা সময় নেয়। এরপর স্পষ্ট অথচ কোমনীয় কন্ঠে—
—দেখুন, আমার কি করা উচিত বলুন তো?
নির্লিপ্ততা ভেঙে—
—মানে!
দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। এরপর আবার স্বরভঙ্গি ফিরে পেয়ে মেয়েটি বলতে শুরু করে।
—আপনার নাটকের সেই মেয়েটির সঙ্গে আমারো যে জীবনের অনেক মিল।
—মানে? কি বলছেন, আপনার নাম কি?
—আফরিন।
নাম শোনার পর এই প্রথম যেন মেয়েটির দিকে চোখ ঢেলে দিয়ে তাকাল কবির, নাটকের মেয়েটির নামে নাম। চোখ বন্ধ করলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে—চারজন বিচারক আফরিনকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে খোয়ারবন্দি করছে। নিজের চোখের সামনে মেয়েটিকে একদল নরপশুর উদ্দাম-উলঙ্গ তাণ্ডব সইতে হয়—সেইসব করুণ-বীভৎসতার কাট কাট দৃশ্য।
কবির এবার ঘটনাটির দায়িত্ব নেয়ার স্বরে বলে—
—আমি কি করতে পারি?
—মেয়েটি যদি পতিতা না-হয়ে কাউকে ভালোবাসে?
—বাসতেই পারে।
—কিন্তু ভালোবাসার লোকটি যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়?
—কেন দেবে? সে তো অসুন্দর নয়। আবার শিক্ষিতও।
বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায় আফরিন। কবিরের যেন বলা শেষ হয়নি, তাই সে গড়গড় করে বলতে থাকে—
—হ্যাঁ, আমি সচেতনভাবেই চরিত্রটিতে একটি চমৎকার মেয়েকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছি। কারণ কাহিনীর প্রয়োজনেই সে এসেছে, কালো বা কুৎসিত মেয়েকে দিয়েও অভিনয় করাতে পারতাম। কিন্তু আমি তা চাইনি।
কালো, কুৎসিত শব্দ দুটি আফরিনের কানে বাজে। সে চোখ বন্ধ করে প্রশ্নের কায়দায় বলে ওঠে—
—কেন?
কবির মেয়েটির চোখবন্ধ মুখের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে তাকায়।
—কারণ কি এই—চোখবন্ধ করেই মেয়েটিকে আপনি আবিষ্কার করেন নিজের মতো করে?
কবির এবার সৃষ্টির গর্বটুকু আঁকড়ে ধরার অভিপ্রায়ে বেশ দরাজ গলায় বলে—
—হ্যাঁ—তাই।
মনের সবুজ মাঠ ক্রমশ বিস্তৃত হতে দেখা যায়, বিস্তার বাড়ে প্রিয়সব অনুষঙ্গের—পর্দায় ভেসে ওঠে সদ্যহাসোজ্জ্বল আফরিনের মুখ, ভাঙা ভাঙা স্বপ্নঘোরে সে ফিরে এসে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় বিচার-মুহূর্তে শঙ্কিত আফরিনের মুখ, মায়ের বুকের সঙ্গে মাথা গুঁজে সেফটিপিনের মতো নিরাপদে ঢাকা পড়ে আছে—শেষ সম্বলটুকু হারানোর ভয়ে।
—দেখুন এই কাহিনী আপনাকে নিয়ে নয়। তাছাড়া আমি তো আপনাকে চিনি না, কখনো দেখাও হয়নি। কি করে লিখব এতসব?
—সে তো আমি জানিই। আপনিই আপনার কল্পনার ভালোবাসাকে ওভাবে নির্যাতিত হতে দিয়েছেন।
—দেখুন এটা ঠিক নয়।
—এটাই ঠিক নাট্যকার সাহেব।
কবির কিছু বলতে চাইলে আফরিন থামিয়ে দেয়।
—এবার বলুন মেয়েটিকে কি আপনি ফিরিয়ে দেবেন?
—আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
—আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই।
—কি বলছেন?
—আমি আপনার সেই ভাবনার নায়িকা, ভালো করে দেখুন তাকিয়ে।
আকাশ ভেঙে পড়ার মতো করে শিউরে ওঠে কবির। মেয়েটি জামার হাতা কিছুটা উপরে টেনে তুলে দেখায়। যেখানে নির্যাতনের সময় একজন সজোরে কামড় বসিয়ে দিয়েছিল। চোখের সামনে প্রদর্শিত নাটকের দৃশ্য ভেসে ওঠে। এটা নিশ্চয়ই নাটক দেখে আমি বানায়নি। কারণ এটা পুরনো দাগ।
—আমি একটু দেখতে পারব—ছুঁয়ে?
কবির কাছে ঝুঁকে গিয়ে আঙ্গুল বুলিয়ে দেখে, কিন্তু বিশ্বাস হয় না। এড়িয়ে যাবার ভঙ্গি না-হলেও, ঘুম আর ক্লান্তি একযোগ করে আড়মোড়া ভেঙে বলে—
—আমার কি করা উচিত আমি জানি না। দেখুন, আমার চোখে প্রচুর ঘুম, ‘তুমি’ও ইচ্ছে করলে ঘুমোতে পারো।
এ-কথা শুনে মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে তাকায়। হ্যাঁ-না কিছুই বলতে পারে না।
কবির দ্রুত বিছানায় গিয়ে দুটো বালিশকে ভাগ করে—শুরুতে জায়গা রেখে একটি বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমপরীরা নাট্যকারের মাথা-মুণ্ডু ভাগ করে খেতে শুরু করে।
আফরিন বসা থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, তারপর কি যেন ভেবে আবার ফিরে আসে, অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে বাসার সবকিছু দেখে নেয়। এরপর ধীরে ধীরে কবিরের পাশে খাটে গিয়ে বসে। ডাকতে গিয়েও পারে না, হয়তো কিছু বলার ছিল। একসময় সেও পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। চোখ দুটো তার কি-এক পরম বিস্ময়ে অস্থিরাক্রান্ত, মুহূর্তে ঠাণ্ডা-শান্ত, আবার খানিকটা বিশ্বস্তও। ঝড়-বৃষ্টিতে ডানা ভাঙা পাখির একচিলতে আশ্রয় পাবার মতো করে যেন সে আড়াল খুঁজে পায়।
সকাল দশটার দিকে ঘুম ভাঙে কবিরের। মুখে পানি দিয়ে বেসিনের গ্লাসে তাকাতেই পদ্মাপাড়ের ঘুমভাঙা কিশোরীবধূর কুয়াশাভেজা ভোরালোয় শান্ত-নিবিড়তায় কোমলোজ্জ্বল মুখ ভেসে ওঠে আফরিনের, সাথে সাথে রাতের ঘটনাটি স্মৃতিনির্ভর ঔৎসুক্যে পরিণত হয়। এবার এ-রুম সে-রুম খুঁজে না-পেয়ে বারান্দায় গিয়ে তার মনে পড়ে, মেয়েটি সামনের বাসাটি দেখিয়েছিল। দ্রুত সে দরজা খুলে রাতে দেখানো বাসায় গিয়ে নক করে। একজন ভদ্রমহিলা দরজা খোলে।
—স্যরি, আফরিনদের বাসা এটা?
—আফরিন! আপনি ঠিক-ঠাক জেনে বলছেন তো।
—কিন্তু আফরিন তো, এই বাসাই দেখিয়েছিল!
—দেখেন, আপনার মনে হয় ভুল হয়ে যাচ্ছে।
—না-মানে, আচ্ছা আপনার ছেলেমেয়ে ক’জন?
—এক ছেলে, এক মেয়ে। দুজনের বয়সই আট, ওরা যমজ।
কবির কিছুতেই কিছু মেলাতে পারে না। নিজের কাছে নিজেই ফিসফিস স্বরে বলে ওঠে—
—রাতের পুরো ঘটনাটি তাহলে কি স্বপ্ন ছিল?
—জ্বি?
—না, কিছু না। ডাকবেন একটু।
ভদ্রমহিলা ছেলে-মেয়ে দুটোকে ডাকতে গেলে কবির সবকিছু মেলানোর চেষ্টা করে—এই মেলানোর চেষ্টার মধ্যেই ছেলে-মেয়ে দুটো এসে কোরাস ছালাম দেয়।
—আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
কবির মৌনসম্মতি জানায় ঠোঁটের সঙ্গে হাত নাড়িয়ে। এবং বুঝতে পারে এখানে আর নয়, তাই সে ফিরে আসে। কড়িডোরের মাঝামাঝি এসে আবার ফিরে তাকায়। ভদ্রমহিলা দরজা আটকাচ্ছিল, তার পিছন থেকে আফরিন হাত নেড়ে তাকে টা টা জানায়। সে আবার ফিরে যায়। পুনরায় নক করে।
—দেখুন, আমি খুবই স্যরি। কিছু মনে করবেন না। কোথায় যেন একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। এইমাত্র যে মেয়েটিকে দেখলাম, সে—কে?
—সে—কে মানে? বাসায় তো আমি আর আমার ছেলে-মেয়ে।
—তাহলে!
—দেখুন, আপনার যদি সন্দেহ হয়…, ভেতরে আসুন।
কবির ভেতরে প্রবেশ করে দরজা আটকিয়ে দেয়। ভদ্রমহিলাকে বন্ধদরজা ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে রেখে কোনো অষ্টমাশ্চর্য আবিষ্কারের সবটুকু উচ্ছ্বাস-আকাক্সক্ষাকে নেশায় রূপ দিয়ে বলে—
—প্লিজ, আপনি এখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকবেন।
ছেলে-মেয়ে দুটি খেলতে বসেছে এরই মধ্যে। ভেতরে প্রথম রুম দেখে দ্বিতীয় রুমে গিয়ে চমকে ওঠে সে, চাদর গায়ে দিয়ে আফরিন শুয়ে আছে। কবিরের মধ্যে মুহূর্তের আবেশে একধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়, কাছে এগিয়ে গিয়ে ভালোবাসাস্নাত ব্যক্তিগত দুর্বলতা ও আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়।
—তোমার কি জ্বর?
—হ্যাঁ।
জ্বরে কাতর আফরিনকে রোগা এবং কমবয়সী দেখায়।
—তাহলে তোমার মা তোমার পরিচয় গোপন করছিল কেন?
—কারণ আমি তো জ্বরে পনেরো বছর আগে মারা গিয়েছি।
কবির চিৎকার করে উঠে—
—হোয়াট?
মহিলা তড়িৎগতিতে দৌড়ে আসে।
—আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন?
কবির মহিলার দিকে ঘুরে ফের তাকাতেই বিছানা খালি।
—এখানেই তো ছিল!
—কই আশেপাশে তো কেউ নেই। আপনি নিশ্চয়ই অসুস্থ। বাসায় যান।
কবির মুখবুজে মাটির দিকে তাকিয়ে ফের চোখ ঘুরিয়ে নেয় উপরে, হঠাৎ প্রশ্ন করে—
—কিন্তু আপনার বড় মেয়ে?
মহিলার কপালে ভাঁজ পড়ে।
—আমার বড় মেয়ে!
—হ্যাঁ, আপনার বড় মেয়ে তাহলে কোথায়? সেকি আগের পক্ষের কেউ…, স্যরি ভুল বুঝবেন না।
ভদ্রমহিলা এতক্ষণে দেয়ালে গিয়ে সেঁটে দাঁড়িয়েছে, চোখ জলটলমল অবস্থা। রুমের ছাদ ফুঁড়ে যেন পরিষ্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে।
—হ্যাঁ, এর আগে আমার আরেক জায়গায় বিয়ে হয়েছিল, সে পক্ষের মেয়ে আফরিন।
—আফরিন!
—হ্যাঁ। সে তো পনেরো বছর আগে জ্বরে মারা গেছে। আর ওর বাবা ঠিকাদারি ব্যবসা করত, চাঁদা না-দেয়ায় পুলিশের হেফাজতে মারা যায়। পরে পত্রিকান্তরে জানতে পারি, শিশু-পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয় এবং অনেক মারপিটের পর থানা থেকে হার্ট এ্যাটাক বলে চালিয়ে দেয়, ডাক্তারি রিপোর্টও ওদের ছিল। লাশ আমরা ফেরত পাইনি। বেওয়ারিস দেখিয়ে পুলিশই লাশ গ্রহণ করে মাটিচাপা দেয়।
মহিলার দু’চোখে জগতের মা ও স্ত্রী জাতির জারিত মোমগলা পানি, বারবার সে ঢোক গেলে। যেন অনেক বলার আছে, বলতে পারে না। সময় নিয়ে মুখে ভাষা ফিরে পায়।
—আফরিন এখনো মাঝে মাঝে আসে, ওর বাবার খবর নিয়ে। আমি মাঝে-মধ্যে খাবার দিয়ে দিই। তুমি এখন যাও, এরপরে আসলে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো।
কবির কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না, নিরুদ্দিষ্ট ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসে।
বাসার ভেতরে ঢুকতেই আফরিনের চড়া কণ্ঠ, কিন্তু কণ্ঠের সঙ্গে লেপ্টে আছে জিগা গাছে ঝুলে থাকা আঠার পেলবস্পর্শ—প্রেম প্রেম, কাম কাম।
—তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
মেলায় হারিয়ে যাওয়া শেষ পয়সা ফিরে পাবার শিহরণের সঙ্গে লক্ষ্যচ্যুত শিকার দেখে চমকে ওঠা হাতড়ানো শিকারীর মতো কণ্ঠ কাঁপিয়ে—
—মানে কি? তুমি এখানে কীভাবে?
—বা, আমি তো বাথরুমে! তুমি কি নিচে গিয়েছিলে। খবর কাগজ নিয়ে এসেছ?
—তুমি বলেছিলে না, সামনের বাসাটি তোমাদের?
—হ্যাঁ বলেছি, তো?
—চলো, তোমার মা’র সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে।
দু’জন একত্রে বের হয়, সামনের বাসায় গিয়ে কবির আবার নক করে। পিছন থেকে আফরিন বলে—
—মা, দরজা খোলো।
আগের দেখা মহিলাই দরজা খোলে। আবেগ আর বিস্ময় একত্র করে মহিলা বলতে থাকে—
—আরে আপনি! কাল রাতে আপনার নাটক দেখলাম। ভালো লেগেছে। আমার এক বান্ধবী ছিল, সে-ও আত্মহত্যা করেছিল। ওর ব্যাপারটাও প্রায় নাটকের মতোই। বড়ভাইয়ের কারণে নিপীড়িত হতে হয়েছিল।
কবির গম্ভীর ও কিছুটা রাগত স্বরে ক্ষেপে যাবার ভঙ্গিতে বলে—
—আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেও তো কথা বলে গেলাম।
মনে মনে, এখন আবার আলগা সার ছিটানো হচ্ছে। একটা পাম্প মেশিন।
—জ্বি, কিছু বলছেন?
—জ্বি না, কিন্তু এ—কে? (দ্রুত ফাস্ট বল ছোড়ার ভঙ্গিতে পেছনের দিকে ইশারা করে)।
—এ-কে মানে?
কবির পাশ ফিরে দেখে মেয়েটি নেই। সে আর কিছু না-বলে বিস্ময়াতুর চোখে-মুখে চলে আসে, ভাবতে থাকে আগের পুরো ঘটনাটাই কি সে স্বপ্ন দেখেছে…? এখন নিশ্চয়ই বাস্তব। বাসায় না-ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পিছন ফিরে তাকায়, দিনের আলো ঢুকে পড়েছে সর্বত্র। কিন্তু সবই যেন ঘোর অমানিশায় ঢাকা। দ্রুত হেঁটে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, জলকাদায় আহত পিচপথ তার কাছে বাজারের কম দরের আলুর মতো মনে হয়। যেন এমন অভ্যাসে সত্যিকারের শহুরে হয়ে ওঠা যায়।
হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর গিয়ে স্থির কদমবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে সে। হঠাৎ তার মনে হলো গায়ের চামড়া কাকের রঙ পেয়ে বসেছে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠা-নামা করছে, অকস্মাৎ সে ফুটপাতে বসে পড়ে : আকাশ দেখে, মানুষ দেখে—মানুষের রঙমুখে ঢাকা পড়া মুখোশের আড়ালে ভিন্নতর সম্ভাবনা ও নাশ দেখে চমকে ওঠে। রিকশার টুং-টাং শব্দ গির্জার ঘণ্টাধ্বনির মতো মনে হয়। উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর বেড়ে ওঠা তালা গোনার চেষ্টা করে। একসময় চোখের সামনে দ্রুতলয়ের একটি ঘিঞ্জি শহর ভেসে ওঠে। ইট-ভাঙা কলের তীব্র ঘড় ঘড় আওয়াজ, গাড়ির কর্কশ শব্দ, ছাইরেন, ভিআইপিদের দৌড়-ঝাপ, এ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ির হর্ন—মাথা-কান ধরে আসে তার, শেষে চোখের সঙ্গে পাল্লা দেয় বুনো-শূয়রের ঘোঁৎ ঘোঁৎ…। ধীরে ধীরে আবার সবকিছু শান্ত হয়ে আসে। সে হাঁটতে থাকে ফুটপাত ঘেঁষে অদেখা-অনিশ্চিয়তায়…
সকাল গড়িয়ে দুপুর, কবির একটা ফাস্টফুড দোকানে ঢুকলে পিছন থেকে আফরিন এসে বলে—
—এই কেমন আছ।
হকচকিয়ে যায় কবির।
—তুমি!
—হ্যাঁ আমি। মাকে চোখের ইশারা করে তোমাকে কিছুটা দ্বিধায় ফেলে দিয়ে চলে আসা, কারণ ক্লাসের টাইম হয়ে যাচ্ছিল।
—একদম তেলেসমাতি খেল দেখিয়েছ, বেশ বেশ, কিন্তু এখানে কি করছ?
—প্রশ্ন তো আমারো, এখানে তুমিই-বা কেন?
—বা! আমি কেন? শাহবাগের আজিজ মার্কেটেই তো আমাদের সব লেখক-বন্ধুদের আড্ডা। কিন্তু তোমার এখানে কি প্রয়োজন?
—আমি ফটোকপি করতে এসেছিলাম।
—কেন, তোমাদের বিখ্যাত নীলক্ষেতের কি হলো?
—ওখানে ফটোকপি খুববেশি ভালো হয় না, আর চারুকলা থেকে এখানেই কাছে হয়। পরে ভাবলাম ‘অন্তরে’ নাস্তাটা সেরেই যাই।
—বা চমৎকার! কিন্তু এখন তোমাকে আর নাস্তা-টাস্তা করতে হবে না। চলো, আমি তোমার ডিপার্টমেন্টে যাব।
—কেন?
—তোমার ইয়ারমেট বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবে।
কবিরের অভিধেয় লক্ষ্য যেন আফরিনও টের পেয়ে যায়। কিন্তু বুঝতে না-দিয়ে অনুনয়ের ভঙ্গিতে আফরিন বলে—
—নাস্তা করব না।
—না।
—বেশ—চলো।
দু’জন হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে গিয়ে চারুকলার গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকে। ঢুকেই চোখে পড়ে জয়নুল গ্যালারির সামনে অনেকের মধ্যে রুমকি দাঁড়িয়ে আছে। আফরিন একপ্রকার চিৎকার করে ডাক দেয়—
—এই রুমকি।
রুমকি দৃষ্টি ফেরায়। যেন আর পরিচয় করে দেবার দরকার নেই এই ভঙ্গিতে আফরিনকে পিছে ফেলে কবির এগিয়ে গিয়ে যেচে কথা বলা শুরু করে—
—আমি কবির। কেমন আছেন?
রুমকি কিছুটা বিস্মিত হয়।
—ভালো, কিন্তু আপনি?
—আপনি মানে আমি।
—কিছু মনে করবেন না, আপনাকে আমি চিনি, বেশ ভালো নাটক লিখেন। কবি কিংবা নাট্যকারদের মধ্যে আপনি আমার খুবই প্রিয়, কিন্তু এভাবে কথা হবে…
—কেন আফরিনই তো…
পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে আফরিন নেই।
—স্যরি, আই এ্যাম ভেরি স্যরি।
কবির আকস্মিকতার লজ্জা আড়াল করতে গন্তব্যমুখী হয়। গেট পার হতেই দেখে আফরিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। সবই যেন ওর চালাকি।
—কি চমকে দিলাম তো, ধরতে পারলে না? রুমকি আমার ভালো বন্ধু, ওকেও মা’র মতো চোখের ইশারা করে চলে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি—তুমি কি করো?
—আমি কি করি মানে? তুমি কি মানুষ, নাকি অন্যকিছু?
—কেন সন্দেহ হয়?
—হ্যাঁ—হয়।
—কি প্রমাণ চাও?
—কি প্রমাণ দিতে পারবে শুনি?
—তুমি যেভাবে চাইবে।
বলা শেষ না-হতেই আক্রমণের ভঙ্গিতে কবির জনসমক্ষে আফরিনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে উদ্যত হয়, আফরিন খাঁচাবন্দি পাখির মতো ছটফট করে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। অস্ফুট স্বর গোঙানিতে রূপ নেয়। এরই মধ্যে সদুৎসাহী কয়েকজন তরুণ ছেলে-মেয়ে এসে আফরিনকে ছাড়িয়ে নেয়। ছেলেগুলো কবিরকে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। ছিলি স্বরে ভেংচিয়ে ভেংচিয়ে বলতে থাকে—
—কি প্রেমিক-মাস্তান, আশিকে-দেওয়ানা?
আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আকুতির সঙ্গে বিছানায় শোয়া থেকে কবির চিৎকার করে ওঠে। বাথরুম থেকে আফরিনও চেঁচিয়ে ওঠে—
—এই কি হয়েছে তোমার, চিৎকার করছ কেন?
—আফরিন?
—কি হলো বলবে তো?
—এদিকে এসো।
—আসছি বাবা।
—এখনই এসো।
—কাপড়-চোপড় পরতে দেবে তো!
—পরতে হবে না—এদিকে এসো।
বাথরুম থেকে বের হয়ে আফরিন সামনে এসে মুচকি হাসি দাঁড়ায়। কবির জানতে চায়—
—কে তুমি?
—আমি কে মানে? আমি তোমার বিয়ে করা বউ, যার সঙ্গে পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে ফুসুর ফাসুর করে প্রেম করেছ (আদরমাখা কণ্ঠে)।
—ওহ্ থামো! কে তুমি তাই বলো?
—ওহো! তুমি তাহলে আজকেও ঐসব আজগুবি স্বপ্ন দেখেছ? এখন ঝাল ঝাড়ছ আমার উপর। ওঠো তো এবার, রেডি হয়ে নাও। বিকেলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখনই চলো।
আফরিনের ঝাঁঝালো কণ্ঠে কবির যেন সম্বিত ফিরে পায়। বিনীতাভিমানের স্বরে বলে—
—এ-ই আমি কি খুব বেশি বলে ফেলেছি?
—না। ‘আপিনি’ বেশি বলবেন কেন? একটু…
—আমি কি করব সোনা? শেষরাতে ঘুমালেই না—ঐসব বিদঘুটে স্বপ্ন দেখি।
—রেডি হও, এক্ষুণি ওঠো।
বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে ব্রাশ করে সেভ সেরে গোসলের পর দ্রুত নাস্তার টেবিলে এসে বসে কবির। আফরিন আগে থেকেই নাস্তা রেডি করছিল। নাস্তা শেষ করেই দু’জনে জামাকাপড় চেঞ্জ করে বাসায় তালা লাগিয়ে নিচে নেমে আসে। গেট দিয়ে বেরিয়ে সামনে একটু এগিয়ে গিয়ে রিকশায় ওঠে। পরিচিত ভঙ্গির সঙ্গে পিঠের উপরে ভাঙা নখের শিরশির অনুভূতি ঘষার চিকন শব্দ হয়। অমনি আফরিন দশাঙ্গুলের মধ্যে কবিরের হাত দুটো বন্দী করে ভাঙা নখ খুঁজে পেয়ে দাঁত দিয়ে কেটে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেয় বাতাসে।
কবির ও আফরিনকে পূর্বপরিচিত একটি ডাক্তারের চেম্বারে বসে থাকতে দেখা যায়। ডাক্তারের সঙ্গে সবকথা আফরিন বলছে। কবির অনেকটা নীরব দর্শকের মতো চুপচাপ বসে আছে।
—আজকেও ঐসব আজগুবি স্বপ্ন দেখেছে, আর আমাকে নানা কিসিমের কত—প্রশ্ন?
সবকথা ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে শোনেন, এরপর প্রেসক্রিপশন লিখতে শুরু করে। কবির হাবাগোবা ভাব করে বসে আছে। এরই ফাঁকে চেম্বারে একজন তরুণী মেয়ের প্রবেশ, ‘আব্বু’ বলে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে ডাক্তারকে। ডাক্তার সাহেব পরিচয় করিয়ে দেন দু’জনের সঙ্গে।
—আমার মেয়ে—আফরিন।
নাম শুনে দু’জনেই চেনা পথের গলির মোড়ে এসে অন্যরকম ইশারায় ফিরে তাকায়। একবার নিজের বউয়ের দিকে, আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকায় কবির। হুবহু দেখতে। কিছুতেই মেলাতে পারে না সে। আবার রাতের দেখা মেয়েটির সঙ্গেও অনেক মিল।
—আমি একটু আসছি।
আফরিন ব্যস্ততার ভান করে উঠতে চায়। কবিরের না-বলা কণ্ঠে যেন কিছুটা ভাষা ফিরে আসে।
—কোথায় যাও?
—এই… টিএন্ডটিতে একটা ফোন করে আসি, এখান থেকে বের হয়ে আমরা সোজা মা’র ওখানে যাচ্ছি।
আফরিন ঝটফট উঠে পড়ে, চেম্বার থেকে বেরিয়ে অদূরে কার্ডফোনে কথা বলতে থাকে। জানালার গ্লাস দিয়ে ফোনবুথ দেখা যাচ্ছিল। এ-দিকে ডাক্তারের সঙ্গে তার মেয়ের আদর ঝরানো সংলাপের সাথে সাত-পাঁচ আবদার-উপাচার ঠোঁটের মোটা হাসি পেরিয়ে দশাঙ্গুলের করে গিয়ে পৌঁছেছে। হঠাৎ কবিরের চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় মেয়েটি থেমে যায়। কাউকে কিছু না-বলেই কবির আফরিনের ফিরতে দেরি হচ্ছে কেন এমন একখানা ভাব করে বেরিয়ে আসে।
সামনে এগিয়ে ফোনবুথের দরজায় নক করতেই ভেতরের মহিলা ঘুরে দাঁড়ায়, বউয়ের চেহারা, কিন্তু মুখমণ্ডলজুড়ে চাপ চাপ রক্তের দাগ, ভয়ঙ্কর সে চেহারা। চিৎকার দিয়ে পাশ ফিরতেই আফরিন পিছন দিক থেকে এসে ধরে ফেলে কবিরকে।
—এই কি হলো? উনি কি ভূত নাকি?
কবির তাকিয়ে দেখল সাধারণ একজন ভদ্রমহিলা। মহিলাও কিছু বুঝে উঠতে না-পেরে চোখের মণি না-নড়িয়ে অপলক চেয়ে থাকে। আফরিন ইশারায় স্যরি বলে।
কিছুই হয়নি যেন, এমনি নিরুদ্বিগ্ন অভিপ্রায়ে কবির জিজ্ঞেস করে—
—কোথায় ছিলে ফোন করতে গিয়ে?
—এই তো ফোন করে তোমার জন্য ঔষধ নিচ্ছিলাম।
অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কবিরের যেন আর তর সইছে না।
—চলো—চলো, বাসায় যাই।
—এত তাড়াহুড়া কেন?
—জানি না, চলো তো।
আফরিন আর কথা বাড়ায় না।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে একটা সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে বসে কবির ও আফরিন। দেখলে মনে হবে, যেন কিছুটা সময় নিচ্ছিল দুজনেই—এক পরিস্থিতি থেকে আরেক পরিস্থিতিতে প্রবেশের অবসর অথবা অপ্রত্যাশিত মুহূর্তের হাত থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচার জন্য। কবির বামে তাকাতেই আচানক আঁৎকে ওঠে, ফোনবুথের মহিলার চেহারায় আবির্ভূত আফরিন। শঙ্কা-আড়ষ্ট কণ্ঠে সে চিৎকার দিয়ে উঠে, ড্রাইভারকে বারবার গাড়ি থামাতে বলে। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে মুহূর্মুহু চিৎকার করে। ঘুমন্ত বাঘের খাঁচায় কৌতূহলে ঢুকে সজাগ বাঘের উপস্থিতি টের পাওয়া অতি আগ্রহীর করুণ পরিণতির আঘাতে সে ছটফট করতে থাকে। কিন্তু ব্যর্থ নিনাদ যেন কারো কানে যায় না। ও-দিকে ড্রাইভার ঘুরে তাকাতেই সে আরো জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁপতে থাকে। তার চেহারাও রক্তাক্ত, হিংস্র-শিকারীর ভয়ানক মুখাবয়বে ঠাসা শরীর, চোখ বের হয়ে ঝুলে পড়ে আছে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকের লম্বা জিহ্বার মতো, আর তাদের বঊ, ছেলে-মেয়েদের মোটা পাছার আকৃতিতে বেরিয়ে পড়েছে রুগ্ন নাভিমূলসহ তলপেট। সে ঠিকমতো গাড়ি চালাতেও পারছে না। কবির অনর্গল বমি করার মতো করে চিৎকার করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে।
—থামাও—থামাও, তোমরা থামাও। আমাকে মুক্তি দাও।
কে-কার কথা শোনে? মুহূর্তের মধ্যে কালবোশেখি ঝড় এসে যেন ভর করেছে অটোরিকশাটিতে। এবার সে ভয়ঙ্কর-বিভৎসরকম চিৎকার দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে, কিন্তু দু’জনেই হাসতে থাকে ভয়ঙ্কর সব হাসি খিলখিলিয়ে। কবির তার শেষাকুতি জানাবার মোত করে বলে—
—তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
ড্রাইভার ও আফরিন জোড়া গলায় প্রমিত উচ্চারণ করে—
—গেলেই দেখতে পাবে।
কবির তবুও মরণপণ চিৎকার করে বলতে থাকে—
—শোনো, গাড়ি থামাও, আমাকে ক্ষমা করো, বলো—আমার কি অপরাধ?
ড্রাইভার ও আফরিনের খুব গম্ভীর ও শবকণ্ঠে ভেসে আসে—
—মৃত মানুষদের কথা বলতে নেই।
কবির এবার যেন কথা বলতেও পারছে না, হাসফাসিয়ে ওঠে। অনুচ্চারিত স্বরে সে বাঁচার জন্য ছটফট করতে থাকে। এবং একপর্যায়ে সে পাগলপ্রায় হয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে।
দিগন্তজোড়া ফাঁকা মাঠ, মাঠের মাঝখানে কালো-বিন্দু সদৃশ্যতা থেকে ক্রমে ভেসে ওঠে মাথার আকৃতি একটা মানুষের মুখ, আরো বেশি কাছাকাছি হলে দৃশ্যপট স্পষ্ট হয়ে উঠে—শরীর মাটির মধ্যে পোতা, মাথা বের করে আছে কবির। চিৎকার করে সে বাঁচার প্রাণপণ শেষ আকুতিটুকু জানিয়ে যাচ্ছে।
—বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। আমি মৃত নই, আমি জীবিত।
আফরিনের শবকণ্ঠ ভেসে আসে দূরাদৃশ্য থেকে।
—না—তুমি মৃত, মৃত।
—না—আমি জীবিত, আমি জীবিত।
একসময় চারপাশের নিত্যদিনের মানুষগুলো শাদাকাপড় গায়ে রক্তাক্ত, ভয়ানক-শববেশে একসঙ্গে চারদিক থেকে ব্যথাভার বিন্দু-সদৃশ্য কবিরের মাথার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। লাল পিপড়েরা কাস্তের আদলে সারি বেধেছে চতুর্দিকে—পোকা-মাকড়ের ছুটে আসার দ্রুততায় একহাজার গুণ তাড়া যোগ করেছে। এবার সে মৃত্যুকান্নায় উতগ্র হয়ে ওঠে। সমস্বরে সবাই বলতে থাকে—
—তোমার জীবিত থাকার প্রয়োজন কী? শরীর থেকে রক্ত না-ঝরলে বুঝতেই পারো না তোমরা কতটা নির্যাতিত আর পতিত। তোমাদের বেঁচে থাকার কোনো দরকার নেই। কারণ তোমরা মৃত। আমরাই জীবিত!

Share us

Leave a Reply

Your email address will not be published.